Home / সর্বশেষ / বর্জনের আস্তাকুঁড় থেকে গ্রহণের চূড়ায় বাংলাদেশি ফাস্ট বোলারের দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ের গল্প

বর্জনের আস্তাকুঁড় থেকে গ্রহণের চূড়ায় বাংলাদেশি ফাস্ট বোলারের দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ের গল্প

বাংলাদেশ দল তখন পাকিস্তানে খেলছে রাওয়ালপিন্ডি টেস্ট। একই সময় জাতীয় দলের ত্রিসীমানাতেই ছিলেন না তাসকিন আহমেদ। চোট-আঘাত এবং ফর্ম আর ফিটনেসহীনতা মিলিয়ে সহসাই ফেরার দরজাও বন্ধ তাঁর জন্য।

মানসিক প্রশান্তির খোঁজে এই ফাস্ট বোলার ওমরাহ করতে ছুটলেন সৌদি আরবে। সেখানে গিয়ে তাঁর মনোজগতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের সাক্ষী মাহবুব আলী জাকি।

ফোনের ওপার থেকে এই কোচই তাসকিনকে বলতে শুনেছিলেন, ‘স্যার, এখন থেকে ক্রিকেটটা আমি সিরিয়াসলিই খেলতে চাই। ’ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির সেই ফোন কলের পর থেকেই তাসকিনের ক্রিকেট জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু।

যে অধ্যায়টি পতনের তলদেশ দেখে আসা এক বোলারের উত্থানের সিঁড়ি ভাঙার রোমাঞ্চকর সফল এক অভিযানেরও, ওমরাহ করে দেশে ফিরে যা শুরু করতে না করতেই

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের হানায় ‘ঘরে থাকার যুদ্ধ’ও শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষের। সেই যুদ্ধের মধ্যেই নিজেকে ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ শুরু হয় তাসকিনেরও। শুরুটা নিজের অ্যাপার্টমেন্টের গ্যারেজ থেকে।

সেখান থেকে চুপিসারে ঢুকে পড়েন করোনায় বন্ধ থাকা ধানমণ্ডির এক জিমেও। ব্যক্তিগত ট্রেনারের তত্ত্বাবধানে নীরবেই বাড়তে থাকে তাঁর পরিশ্রম, কমতে থাকে ওজনও।

একই সঙ্গে পেশি আরো মজবুত করতে তাঁকে নিয়মিতই ছুটে যেতে দেখা গেছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী বালুচরেও। ‘মাইন্ড টিচার’ রেখে তাঁর মানসিকভাবে সুস্থির হতে চাওয়াও বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়ে ওঠে নতুন এক চর্চার প্রতিশব্দ।

ফিটনেস বাড়ানোর পাশাপাশি বোলিংয়ের ধার বাড়ানোর কাজও চলতে থাকে সমানতালেই। পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের পুরস্কারও তাই ধরা দিতে থাকে করোনায় বন্ধ থাকা ক্রিকেট শুরু হয়ে যেতেই। তিল তিল করে নিজেকে বিরুদ্ধ কন্ডিশনের উপযোগী করে তোলার ফলও মিলতে শুরু করে।

এবারই দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আগ্রাসী বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে প্রোটিয়াদের মাটিতে তাঁদের বিপক্ষে প্রথম জয়ের ইতিহাসে নিজের নাম জুড়ে নেন ভালোভাবেই।

জোহানেসবার্গে পরের ম্যাচ শেষ হতে না হতেই শোনেন আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি লখনউ সুপার জায়ান্ট পুরো মৌসুমের জন্য চায় তাঁকে। আসন্ন টেস্ট সিরিজ বিবেচনায় তাঁকে বিসিবির অনুমোদন না দেওয়ার মধ্যেই মাশরাফি বিন মর্তুজাও খুঁজে পান তাসকিনের বর্তমান গুরুত্ব।

এই তরুণ ফাস্ট বোলারের ক্রিকেট জীবনের এলোমেলো প্রথম অধ্যায়েরও সাক্ষী ওই সাবেক অধিনায়ক। বদলটা তাই আরো ভালো ধরতে পারা মাশরাফি ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসেও এটি উল্লেখ না করে পারেননি যে ‘৩ বছর আগে তোমাকে দলে দেখলে সবার রাগ হতো, আর আজ দলে তোমার গুরুত্ব তুমি নিজেই দেখছ। ’

ঠিক তা-ই। মুদ্রার এক পিঠে তাসকিন দেখেছেন যে জাতীয় দলে পরম প্রার্থিত কোনো চরিত্র তিনি নন। এতে নিজের দায়ও অস্বীকার করেননি কখনো। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এর আগের সফরে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্পেলে বোলিং করতে গিয়ে তাঁকে হাঁসফাঁস করতে দেখা নিয়ে দলের মধ্যেই না ছিল কত বিরূপ সমালোচনা।

বিশৃঙ্খল ব্যক্তি জীবনও তাতে ভূমিকা রেখেছিল অনেকটা। দলের সম্পদ না হয়ে বরং বনে যান বোঝা। ছিটকেও পড়তে হয় দ্রুতই। সেই ছিটকে পড়াটা একরকম বর্জনের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষেপ করে তাসকিনকে। জাতীয় দল থেকে এমন দূরে সরে যান যে ফেরার সম্ভাবনার ঝিলিকও দেখা যাচ্ছিল না।

সেখান থেকে আবার গ্রহণের দুয়ার খোলার জন্য যে বোধোদয়ের দরকার ছিল, সেটি আসে সেই রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের সময়। ওমরাহ করে ফিরেই শুরু করেন একার যুদ্ধ। যে যুদ্ধে তাঁর সাফল্যের মুকুটে স্বীকৃতির সবচেয়ে দামি পালকটি কাল যুক্ত হলো সেঞ্চুরিয়নে। এত দিনকার সুরক্ষিত দক্ষিণ আফ্রিকান দুর্গ তছনছ করলেন ৩৫ রানে ৫ উইকেট নেওয়া ইতিহাস গড়া পারফরম্যান্সে।

যা প্রোটিয়াদের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ের দিন তাসকিনকে ভাসালো দ্বৈত অর্জনের আনন্দেও। যেটিকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়েই বড় বলে রায় দিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালও, ‘একই সঙ্গে ম্যাচ ও সিরিজ সেরা হওয়াটা আমি মনে করি আইপিএল খেলার চেয়েও বড় কিছু। ’

বর্জনের আস্তাকুঁড় দেখে আসা তাসকিনও যেন এখন গ্রহণের চূড়ায়ই নিজেকে আবিষ্কার করছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *